
কক্সবাংলা ডটকম(২৮ অক্টোবর) :: বাংলাদেশ খাদ্য অপচয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার শীর্ষ ৫ দেশের একটি। খাদ্য নষ্ট হয়ে থাকে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে। সে হিসেবে বছরে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৩৪ শতাংশই নষ্ট হয়।
তাছাড়া ২০১৬-২০২৪ সাল পর্যন্ত যেসব দেশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে অবস্থান করছিল সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়।
ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) ‘ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স ২০২৪’ ও ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস (জিআরএফসি) ২০২৫’-এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একটি বাড়িতে বছরে ৮২ কেজি খাদ্য নষ্ট হয়। খাদ্য নষ্টের তালিকায় এশিয়ার শীর্ষ ৫ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।
খাদ্য নষ্টের তালিকায় বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ। দেশটি বছরে পরিবারপ্রতি ২০৭ কেজি খাদ্য নষ্ট করে।
পাকিস্তানে হয় ১৩০, আফগানিস্তানে ১২৭, নেপালে ৯৩, বাংলাদেশ ৮২, শ্রীলঙ্কা ও চীনে ৭৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ ও ভারতে ৫৫ কেজি।
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে ছিল বাংলাদেশ
গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস অনুযায়ী, ২০১৬-২০২৪ সাল পর্যন্ত ৮ বছর বিশ্বের যেসব দেশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে অবস্থান করছিল সেখানে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয়।
জিআরএফসির রিপোর্ট মতে, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে সর্বোচ্চ স্তরে ছিল নাইজেরিয়ার মানুষ ৩১.৮ মিলিয়ন, সুদান ও কঙ্গোর ২৫.৬, বাংলাদেশের ২৩.৬, ইথিওপিয়ার ২২, ইয়ামেনের ১৬.৭, আফগানিস্তানের ১৫.৮, মিয়ানমারের ১৪.৪, পাকিস্তানের ১১.৮ মিলিয়ন।
কোন খাদ্য কী পরিমাণে নষ্ট হয়
সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল। সেই চালের প্রস্তুতির পূর্বে পোস্টহার্ভেস্ট পর্যায়ে ধান নষ্ট হয় ১৭.৮০ শতাংশ। ফসল কাটার পর ধানের গড় ক্ষতি বা নষ্ট হয় ১৭.৮০ শতাংশ।
তার মধ্যে কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী এবং মিলারদের স্তরে নষ্ট হয় ১৪.০২ শতাংশ। পরিবহনে ১.৪, মাড়াইয়ে ১.৭, ঝাড়ায় ১.৫, শুকানোতে ২.৬, সংরক্ষণে ৬.৮, মধ্যস্বত্বভোগীতে ১.৬২ এবং মিলারদের ক্ষেত্রে ২.১২ শতাংশ। তবে ফসল কাটার আগে ক্ষতিসহ মোট ধানের ক্ষতি হয় ২৩ থেকে ২৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য হচ্ছে গম। কাটার পর এই গমের গড় ক্ষতি ১৭.৫৯ শতাংশ। ফল এবং শাকসবজি কাটার পর ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়। আম ৩১.৭, কলা ১৯.৯, আলু ২১.৮, গাজর ২৬.৮, টমেটো ২৭.৯ শতাংশ।
তবে সার্ক কৃষি তথ্যের হিসেবে, বাংলাদেশে বার্ষিক শস্য অপচয় ১২.৯ শতাংশ, শিকড় ও কন্দ ৩৬.৯, তৈলবীজ ও ডাল ১০.৩, ফল ও শাকসবজি ৪০.২, মাংসজাত দ্রব্য ১৪.৯, মাছ ও সামুদ্রিক খাদ্য ৩০.২, দুগ্ধজাত দ্রব্য ১৭.৫ এবং অন্যান্য খাদ্য ২৪.৯ শতাংশ।
গরু ও মহিষের দুধ দোহনের পর নষ্ট হয় ২৪.৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে গরুর ৮.০৭ এবং মহিষের ১৫.৬৭ শতাংশ। ডিম নষ্ট হয় ১২.৯ শতাংশ, হাঁস ও মুরগির মাংস ১৬.৯, গরু ও মহিষের মাংস ২১.৪ শতাংশ নষ্ট হয়।
তা ছাড়া মাংস এবং মাংসজাত দ্রব্য ৫-৯ এবং দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে নষ্ট হয় ৮-১২ শতাংশ। ছোট মাছ ধরার পর নষ্ট হয় ২৫.৪৫ ও কার্পজাতীয় মাছ ১৮.১৩ শতাংশ। মাছের পাত্র বাঁশের ঝুড়িতে ২৩ শতাংশ, ফ্রিজে ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত মানের ক্ষতি হ্রাসে ভূমিকা রাখে।
খাদ্য নষ্ট করে কারা
গবেষণায় দেখা গেছে, ধনী পরিবারগুলোতে খাদ্যের অপচয় সবচেয়ে বেশি। আর দরিদ্র পরিবারগুলোতে সবচেয়ে কম। উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীর ১০০ শতাংশ পরিবার প্রতি সপ্তাহে ০.৫ থেকে ২.০ কেজি খাদ্য অপচয় করে। অর্থাৎ তারা প্রতিবছর প্রায় ২৬-১০৪ কেজি খাদ্য অপচয় করে।
কী বলেছেন বিশেষজ্ঞরা
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশে খাদ্যের অপচয় ও ক্ষতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আমাদের উৎপাদিত খাদ্যের আনুমানিক ৩৪ শতাংশ নষ্ট হয়। একই অনুষ্ঠানে ডব্লিউএফপি বাংলাদেশের অফিস ইন চার্জ ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসি উড বলেন, ফসল কাটার পর ৮-১৫ শতাংশ ধান নষ্ট হয় এবং ২০-৪০ শতাংশ ফল ও সবজি নষ্ট হয়।
এসবের মূল্য ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শাকসবজি, মাছ এবং প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন করে। সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে উৎপাদিত পণ্যের বাইরেও বিপুল পণ্য আমদানি করতে বাধ্য হয়।
অপচয় রোধে সরকারি উদ্যোগ
ক্ষুদ্র কৃষকদের শাকসবজি নষ্টের হাত থেকে রক্ষায় কৃষি মন্ত্রণালয় ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সাশ্রয়ী কোল্ডস্টোরেজ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি প্রকল্প’ শীর্ষক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পটির পরিচালক তালহা জুবাইর মাসরুর বলেন, দেশে ২৫ মিলিয়ন টন খাদ্য উৎপাদিত হলেও নষ্ট হয়েছে ৫ মিলিয়ন টন বা ৩০-৪০ শতাংশ। তিনি বলেন, মিনি কোল্ড স্টোরেজ ব্যবহারের মাধ্যমে সবজি, ফল ও অন্যান্য পচনশীল কৃষিপণ্যের সংরক্ষণকাল বাড়িয়ে খাদ্য অপচয় রোধে ভূমিকা রাখবে।
দেশে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হলেও নষ্টও হয় বেশি। এজন্য সরকার জলবায়ুর প্রতিকূল প্রশমনে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণে অভিযোজন প্রকল্প নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছে।
প্রকল্পটির পরিচালক ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, দেশে বছরে ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। সেখানে ১০ লাখ টন পচে যায়। সেখানে আমাদের প্রয়োজন ৩০ লাখ টন। তাই বাড়তি ৫ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। তাই এই প্রকল্পের মাধ্যমে পেঁয়াজ নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষায় কৃষকদের এয়ার ফ্লো মেশিন দিচ্ছি। চলতি বছর ৩ হাজার ৭০০ কৃষককে এসব মেশিন দেওয়া হবে। একেকটি মেশিনে ২০০-৩০০ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে।
এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (গবেষণা অনুবিভাগ) মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলু বলেন, পোস্টহার্ভেস্ট পর্যায়ে খাদ্য অপচয় রোধে কৃষকদের কোল্ড স্টোরেজ ও মিনি কোল্ডস্টোর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের অধীনে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

Posted ৬:৩৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta